কেফায়েত উল্লাহ খান, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন
করোনায় লকডাউনের কারণে টেকনাফে আটকা পড়েছিল সেন্টমার্টিন দ্বীপের অসহায় কিছু গরীব মানুষ। তারা টেকনাফ গিয়েছিল কয়েকজন নিজ জুরুরি কাজে আর কিছু জন গিয়েছিল চিকিৎসা নিতে। তন্মধ্যে কয়েকজন ছাত্রও ছিল। আজ লকডাউনের আজ ২মাস অতিবাহিত হতে চলছে। ২মাস ধরে তারা টেকনাফে আটকা পড়ে আছে।
এই দিকে লকডাউনের কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে স্থানীয় যাত্রীবাহী ট্রলারও বন্ধ। তবে মালবাহী ট্রলারগুলো চালু রয়েছে। হয়তো তাই আটকা পড়া লোকগুলোও নীরবে দিন পাড় করছে।
অন্যদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আটকা পড়া গরীবের মা রয়েছে মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। জীবন্ত মাকে একবার দেখতে তাদের অনেক আকুতি।
কিন্তু গরীবের পাশে কে থাকে! কে শোনে কার কথা!
সেন্টমার্টিন দ্বীপ ৩নং ওয়ার্ডের ২জন বাসিন্দা (মহিলা)। তারা লকডাউনের আগের দিনই টেকনাফ গিয়েছিল চিকিৎসা নিতে আর সরকারি ভাতা তুলতে। বর্তমানে তাদের মা মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তারা তাদের মা কে একবার দেখার জন্য টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন আসার জন্য অনেকবার আকুতি বিনীত করেও দ্বীপে আসার তাদের অনুমতি হয়নি। তাদের একাধিকবার টেকনাফ ঘাট থেকে বারেবারে ফিরে যেতে হয়েছিল।
শেষ দুদিন প্রসঙ্গে তাদের কাছ থেকে জানা গেল, ১ম দিনঃ প্রথমে তারা টেকনাফ ঘাটে গেলে, মাঝিমাল্লারা কোস্ট গার্ডের অনুমতি আনতে বলে সাফ জানিয়ে দেয়। কোস্ট গার্ড বরাবর অনুমতি প্রার্থনা করলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারদের সার্টিফিকেট থাকলে আসতে কোন বাঁধা নেই বলে জানান। পরে তারা ডাক্তারের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে যখন টেকনাফ ট্রলার ঘাটে আসে তখন মাঝিমাল্লারা বলে চেয়ারম্যানের অনুমতিও লাগবে বলে জানি দেয়। ঐদিন চেয়ারম্যান মেম্বাররাসহ দ্বীপের অনেক মান্যবর ব্যক্তিরাও ছিলেন টেকনাফ ঘাটে। তারা তাদের আশ্বস্তও করেন একসাথেই সেন্টমার্টিন চলে আসতে পারবে বলে।
পরে ঘটে গেলে অন্য কাহিনী। তিনটা স্পীড বোট দিয়ে ঐদিন বদির জেটিঘাট (বদির জেটি নামে পরিচিত) হয়ে ১৭জন মহামান্যরা গরীবদেরকে ফাঁকি দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রবেশ করে। তাদের কাহারও ছিল না ডাক্তারির সুস্থতার সনদ। তাদের ছিল না কোন প্রশাসনের অনুমতি। ঐদিন সেন্টমার্টিন দ্বীপে আসার মহামান্যদের মাঝে ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হয়ে ফেরার যাত্রী। তাদের মধ্যেই অনেকে লকডাউনের মাঝে একাধিকবার আসা যাওয়াও করেছিল। কারণ তারা মহামান্য। তাদের কোন করোনা থাকতে পারেনা।
২য় দিনঃ যথাসময়ে টেকনাফ ঘাটে উপস্থিত গরীবের পরিবার। ফের ডাক্তারি সনদের জন্য প্রেরণ। ডাক্তারি সনদ সংগ্রহ করে আবারও অপেক্ষামান সেন্টমার্টিন দ্বীপে ফিরে মৃত্যু সন্ধিক্ষণে প্রিয় মা কে দেখতে। বারেবারে মাঝিমাল্লারা তাদেরকে বলেই যাচ্ছে চেয়ারম্যান অনুমতি ছাড়া তাদেরকে নেওয়া যাবে না। চেয়ারম্যানের নিষেধাজ্ঞা আছে। কি আর করার গরীবের জন্য কেউ নেই। তাই নিজেই একটু নড়েচড়ে উঠলাম।
ফোন দিলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপ কোস্টগার্ডের অফিসার বরাবর। বিস্তারিত অফিসারকে অভিহিত করলাম। জবাবে অফিসার বললেন, “আপনাদের এলাকার নেতারা এই কেমন নেতা! যেখানে ডাক্তারের সনদ নিয়ে এসেছেন, আর তাছাড়া মা মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আর সেখানে কোন সমাধান না দিয়ে নেতারা ফাঁকি দিয়ে চলে আসে। আমার এলাকা না হয়ে আমারও বড় আফসোস হয়। কেউ ডাক্তারের সনদ নিয়ে আসলে সে লোক দ্বীপে ডুকতে কোন বাধা নেই” এই বলে লাইন ডিসকানেকটেড হয়ে গেল।
এবার টেকনাফ মাঝিমাল্লাদের ঘোষণা এলো সমিতির সভাপতির অনুমতি আনতে হবে। কি আর করার, এবার ফোন দিলাম সভাপতির কাছে। সভাপতি বিষয়টি জানতে পারলো। তখন সভাপতি নিজেই কোস্ট গার্ডের অনুমতি নিয়ে মাঝি মাল্লাদের দুজন যাত্রীদের আনতে বলে। অবশেষে দুজনের মধ্যে একজন ট্রলারে উঠে পড়ে, অন্যজন উঠতে গিয়ে পরক্ষণেই ঘটে যায় বিপত্তি। মুহুর্তেই তাদের ব্যাগপত্র ট্রলার থেকে বাইরে নিক্ষেপ করে। চেয়ারম্যান অনুমতি ছাড়া নেওয়া যাবেনা বলে যে জন উঠে গিয়েছিল তাকে নামতে বাধ্য করে।
ফের তাদের ফিরে যেতে হলো সেই আটকা পড়া স্থান টেকনাফের অস্থায়ী ঠিকানায়।
গরীবদের নিয়ে রাজনীতি আর কতদিন। ইনশাআল্লাহ একদিন এই রাজনীতি এই দ্বীপের সমাজ ব্যবস্থা, এই দ্বীপের প্রতিনিধিত্ব সবই গরীবরাই রাজত্ব করবে।
দুঃখিত হে অসহায় পরিবার। আজ তোমাদেরকে মা কে দেখতে দ্বীপে ঢুকতে অনুমতি করে দিতে পারলাম না। আগামীকাল আবারও চেষ্টা চালিয়ে যাব। এর মধ্যেই যদি তোমাদের মা পরকালে চলে যায়, হয়তো তোমাদের মা কে তোমরা আর দেখবে না। কষ্ট পাবেন। তবুও আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
এম কেফায়েত উল্লাহ খান
সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে!
Leave a Reply