নিজস্ব প্রতিবেদক:
টেকনাফে পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা নারী মাদক চোরাকারবারীর সংখ্যা টেকনাফে পুলিশ চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর অব: মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ডের জেরধরে জেলা পুলিশকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে একযোগে বদলীর পর এখনো পুলিশের কার্য্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি। এরই সুযোগে টেকনাফের প্রত্যন্ত এলাকার মাদক কারবারী, অবৈধ অস্ত্রধারী, ডাকাত, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়কারী চক্র বেপরোয়া হয়েছে। সেই সাথে বাড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক দূর্বৃত্তদের অপতৎপরতা। এখন লক্ষ্য করার ব্যাপার হচ্ছে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ মাদক চোরাকারবারীদের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশু-কিশোর ও নারী মাদক কারবারীদের সংখ্যা। যা দেশ এবং জাতির জন্য এক অশনি সংকেত বলে আশংকা করা হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ৩৮৮.৬৮বর্গকিলোমিটার আয়তনের টেকনাফের ১৪৩টি গ্রামেই কম-বেশী প্রাপ্ত বয়স্ক মাদক চোরাকারবারী রয়েছে। মাদক চোরাচালানে নগদ টাকা আয়ে লোভাতুর হয়ে পড়ে মাদক চোরাকারবারীদের স্ত্রীরা। তাই মাদকের চালান বহন সহজ এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন বয়সের নারী, শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে আসছে। বেকারত্ব আর অভাবের তাড়নায় এসব মাদক চোরাকারবারীদের মাদকের চালান বহন করতে গিয়েই অনেক নারী, শিশু-কিশোর ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম,কক্সবাজার ও টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে কারাগারে রয়েছে। আবার অনেকে জামিনে এসে এখনো নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর শ্লথগতির চিহ্নিত মাদক কারবারীদের অনেকে নিজেদের অপতৎপরতা জিঁইরে রাখতে সরকারী-বেসরকারী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায়, বিভিন্ন পেশার আড়ালে এবং স্বশস্ত্র গ্রæপের সদস্য হওয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেনা। মাদক কারবারীরা এখন সমাজে এতই প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ সহজে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেনা।
বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিভিন্ন স্থানে জিঁইয়ে থাকা মাদক কারবারীদের ছত্রছায়ায় শিশু-কিশোর ও নারী মাদক চোরাকারবারীদের সংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। আইন-শৃংখলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার করা না হলে এবং এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে এই পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হতে পারে।
উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চাকমারকূল গ্রাম থেকে শুরু করে শাহপরীর দ্বীপের ঘোলা পাড়া এবং নাফনদী উপকূল হতে বাহারছড়া উপকূলীয় ইউনিয়ন পর্যন্ত ১৪৩টি গ্রাম ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে এখন শিশু-কিশোর এবং মহিলা মাদক চোরাকারবারী এবং বহনকারীদের আনা-গোনা চোখে পড়ার মতো। হোয়াইক্যং মনিরঘোনা, তুলাতলী, খারাইগ্যাঘোনা, বালুখালী পাড়া, কোনার পাড়া, লাতুরীখোলা, চাকমার কূল, লম্বাবিল, কুতুবদিয়া পাড়া, কাঞ্জরপাড়া, নয়াপাড়া, ঝিমংখালী, মিনা বাজার, নয়াবাজার, পশ্চিম সাতঘরিয়া পাড়া, কাঁচার পাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মহেশখালীয়া পাড়া, কম্বনিয়া পাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের মরিচ্যাঘোনা, আলী আকবর পাড়া, রোজার ঘোনা, মৌলভী বাজার, বৃহত্তর পানখালী, মইন্যারজুম, লেচুয়াপ্রাং, পূর্ব সিকদার পাড়া, ফুলের ডেইল, পশ্চিম সিকদার পাড়া, দরগাহ পাড়া, ঊলুচামরী, নাটমোরা পাড়া, গাজী পাড়া, রঙ্গিখালী, আলীখালী, বৃহত্তর লেদা, মোচনী,নয়াপাড়া, জাদিমোরা, দমদমিয়া, টেকনাফ পৌর এলাকার নাইট্যং পাড়া, জালিয়াপাড়া, কাইয়ুক খালী পাড়া, পল্লান পাড়া, সদর ইউপির নাজির পাড়া, মৌলভী পাড়া, শীলবনিয়া পাড়া, ইসলামবাদ, ডেইল পাড়া, মহেশখালীয়া পাড়া, লেঙ্গুরবিল, হাবিরছড়া, মিঠাপানির ছড়া, রাজারছড়া, সাবরাং মৌলভী পাড়া, হারিয়াখালী, সিকদার পাড়া,ডেগিল্লার বিল, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের ঘোলার পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, পশ্চিম পাড়া, মিস্ত্রীপাড়া, বাজার পাড়া ও জালিয়া পাড়া এবং উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী পাড়া হতে শামলাপুর বাজার হয়ে পুরান পাড়া পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে নারী মাদক চোরাকারবারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। যা বিগত সময়ে বিভিন্ন আইন-শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে প্রতীয়মান হয়েছে। গত ৭/৮মাসে করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক ছাত্র মাদক সংশ্লিষ্ট বন্ধুদের সংস্পঁশে গিয়ে অনেকে বিপদগামী হয়ে উঠছে বলে বিভিন্ন সুত্র থেকে দাবী উঠছে।
এসব এলাকার অনেক নারী মাদকের চালান বহন এবং নিজস্ব মাদকের চালান নিয়ে গিয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে। অনেকে জামিনে আসলেও এখনো অনেকে কারাগারে রয়েছে। কম্বনিয়া পাড়ার এক ব্যক্তি বলেন, অভাবের তাড়নায় অত্র এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদক কারবারীদের ইয়াবা ও চোলাই মাদকের চালান বহন করতে গিয়েই এই গ্রামের শতাধিক নারী ও কিশোর মাদক মামলায় আসামী হয়েছে। অনেকে জামিনে এলেও আবার অনেকে আর্থিক দৈন্যতায় কারাগারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।
হোয়াইক্যং লম্বাবিলে এক চিহ্নিত মহিলা মাদক কারবারীর অপতৎপরতায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন।
মরিচ্যাঘোনার এক ব্যক্তি জানান,এই গ্রামে মাদকের স্বশস্ত্র শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। অভিযান পরিচালনাকারী প্রশাসনের কতিপয় সদস্যকে বশে আনতে রূপসী নারীদের কৌশলে ব্যবহার করে থাকে। পানখালীতেও সুদর্শনা নারী মাদক কারবারী সিন্ডিকেট রয়েছে। হ্নীলা পশ্চিম সিকদার পাড়ায় মালয়েশিয়া প্রবাসী ইসমাঈলের স্ত্রী রেহেনা ক্রসফায়ার মামলার পলাতক আসামী হয়ে এখনো ৪/৫জনের সিন্ডিকেট নিয়ে নয়াবাজার থেকে মাদকের চালান সংগ্রহ করে এলাকার পরিবেশ দূষিত করছে বলে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন। জনৈক কালু আর রেহেনা জামাই-শ্বাশুড়ি সিন্ডিকেট এখন প্রকাশ্যে মাদকের অপতৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব মাদকের চালান সরবরাহ করছে রেহেনার বিদেশ ফেরত ভাই মাঈনুদ্দিন বলে জানা গেছে।
অপরদিকে রশিদ মিস্ত্রী বলেন আমরা না বুঝে আগে অনেক খারাপ কাজ করেছি। এখন ভাল হতে চাই। প্রকৃতপক্ষে জনৈক শওকত আলীর জামাই হামিদ উল্লাহ মরিচ্যায় অবস্থান করে এই রেহেনার মাধ্যমে এখন এলাকায় ওপেন সিক্রেটে মাদক কারবার চালাচ্ছে ; যা খুবই দুঃখজনক। তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার।
ফুলের ডেইল গ্রামেও এখনো পর্যন্ত কয়েকজন নারী মাদক বিক্রেতা সক্রিয় থাকার পাশাপাশি ৬/৭জনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা এখনো কৌশলে মাদকের চালান পাচার করছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এছাড়া রঙ্গিখালী থেকে দমদমিয়া এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক নেতা বলেন, এখানে কার কথা কে শুনে যার যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। মাদকের চালান বহন এই ক্যাম্পের মানুষের জন্য সাধারণ বিষয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে মাদকের চালান নিয়ে শতাধিক রোহিঙ্গা নারী রয়েছে। অনেকে ইতিমধ্যে কারাভোগ করে ফিরেছে।
বাহারছড়ার এক ব্যক্তি জানান, এখানে বয়স্ক পুরুষ মাদক কারবারীদের চেয়ে মহিলাদের তৎপরতা কম। এখনো কোন মহিলা আটক না হওয়ায় স্পষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছেনা। তবে কিছু মহিলার চলাফেরা সন্দেহভাজন।
টেকনাফ পৌর এলাকার এক সচেতন ব্যক্তি জানান,এখন মাদক সম্পৃক্ত মানুষেরা এতই বেপরোয়া যে কাউকে মানুষ মনে করেনা এবং সহজে কাউকে পাত্তা দিতে চাইনা। তাই গুটি কয়েক মানুষ ইজ্জত রক্ষার্থে কিছু বলছেনা। সম্প্রতি মাদক সম্পৃক্ত নারী-পুরুষের অপতৎপরতায় আমরা উদ্বিগ্ন।
এদিকে টেকনাফের এসব অপতৎপরতা বন্ধে অনেক রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, মিডিয়া কর্মী, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ লোক দেখানো প্রতিবাদ করলেও আড়ালে এসব অপরাধীদের সাথে আতাঁত থাকায় টেকনাফ সীমান্তকে মাদকমুক্ত করা যাচ্ছেনা। প্রকৃতপক্ষে টেকনাফকে মাদকমুক্ত করতে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় আরো কঠোর, সর্বস্তরের মানুষের নিঃস্বার্থ অংশ-গ্রহণ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমুহকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি (তদন্ত) আব্দুল আলিম জানান,মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার রয়েছে। তবে মাদক কারবারী যেই হোক সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আরো কঠোর অভিযান জোরদার করা হবে।
টেকনাফ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অস্থায়ী জোনের সহকারী পরিচালক দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান জানান, আমরা বিভিন্ন তথ্য অনুসন্ধানে জানতে পারি ইদানীং মাদক কারবারের মূলহোতারা কৌশলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় নারীদের লোভ দেখিয়ে মাদক কারবারে সম্পৃক্ত করেছে। গত ২/৩ মাসে আমরা ৭/৮জন মহিলা মাদক কারবারীদের আটক করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের এই অভিযান আগামীতে আরো জোরদার করা হবে।
Leave a Reply