অনলাইন ডেস্ক
লিঙ্গ পরিবর্তন করা তৃতীয় লিঙ্গের সাথে বসবাস করে সম্পর্কের বিরোধে ঢাকার আশুলিয়ায় হত্যাকান্ডের শিকার হন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি। ডিএনএ পরীক্ষায় অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় সনাক্ত পূর্বক হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন সহ জড়িত আসামী নওশাদ চম্পা স্বপ্না নামের তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তিকে কে গ্রেফতার করেছে পিবিআিই ঢাকা জেলা। গত ১৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ রাত অনুমান ০৮.০০ টায় গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলকার হিজড়া পল্লি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
আজ ২৬ অক্টোবর ২০২৩ খ্রিঃ তারিখে দুপুর ১২.০০ ঘটিকায় পিব্কিআই হেডকোয়ার্টার্সে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন পিবিআই প্রধান জনাব বনজ কুমার, বিপিএম (বার), পিপিএম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- পিবিআই এর ডিআইজি (পূর্বাঞ্চল) জনাব মোর্শেদুল আনোয়ার খান, ডিআইজি (পশ্চিমাঞ্চল) জনাব মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, বিপিএম, পিপিএম, অতিরিক্ত ডিআইজি জনাব মোঃ সায়েদুর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি জনাব জনাব মোহাঃ আব্দুল মালেক এবং পুলিশ সুপার, পিবিআই ঢাকা জেলা।
গত ৭ জুন ২০২১ তারিখ আশুলিয়া থানার সাধারন ডায়েরী নং-৩৫০ তারিখ ০৭/০৬/২০২১ খ্রিঃ মূলে সঙ্গীয় ফোর্স সহ এসআই (নিঃ) মোঃ শফিউল্লাহ শিকদার আশুলিয়া থানা এলাকায় ডিউটি করাকালে সকাল ০৯.৩০ ঘটিকার সময় সংবাদ পান যে, আশুলিয়ার এনায়েতপুর গ্রামের জনৈক আকতার হোসেন এর বাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্বে মোঃ হাবিবুর রহমান এর ফাঁকা জমিতে বস্তাবন্দি অজ্ঞাত লাশ পড়ে আছে। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বস্তায় ভর্তি অজ্ঞাতনামা পুরষ (৩৫) এর অর্ধগলিত লাশ পেয়ে সুরতহাল প্রস্তুত করেন। ধারণা করা হচ্ছিল; অজ্ঞাতনামা আসামী বা আসামীরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ গুম করার লক্ষ্যে ঘটনাস্থলে বস্তা ভর্তি করে ফেলে রাখে। এই ঘটনায় আশুলিয়া থানার এসআই (নিঃ) মোঃ শফিউল্লাহ শিকদার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানার মামলা নং-২৪, তারিখঃ ০৮/০৬/২০২১ খ্রিঃ, ধারাঃ ৩০২/২০১/৩৪ দন্ডবিধি আইনে হত্যা মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশ মামলাটি ০২ মাস তদন্ত করে। থানা পুলিশ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সহ বাংলাদেশের সকল থানায় বার্তা প্রেরণ পূর্বক অজ্ঞাতনামা লাশের সনাক্তের চেষ্টা করে। লাশ সনাক্ত না হওয়ায় এবং মামলাটি ক্লুলেস হওয়ায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার পিবিআই ঢাকা জেলায় হস্তান্তর হলে এসআই (নিঃ) মোঃ আনোয়ার হোসেন মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন।
পিবিআই প্রধান অ্যাডিশনাল আইজিপি জনাব বনজ কুমার মজুমদার, বিপিএম (বার), পিপিএম মহোদয়ের দিক-নির্দেশনায় এবং পিবিআই ঢাকা জেলার ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার জনাব মোঃ কুদরত-ই-খুদা এর তত্ত্ববধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) মোঃ আনোয়ার হোসেন অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় সনাক্তকরণ সহ মামলাটির প্রকৃত রহস্য উদঘটনের লক্ষ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) মোঃ আনোয়ার হোসেন মামলার ঘটনাস্থল সহ আশ-পাশে যোগাযোগ করেন। পার্শ্ববর্তী ৫ম তলা বিডিং এর মালিক মোঃ আক্তার হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান যে, লাশ পাওয়ার পরের দিন তার বাসার নিচতলার ভাড়াটিয়া চম্পা নামের এক তৃতীয় লিঙ্গের এক ব্যক্তি তার বাবার অসুস্থ্যতার কথা বলে তার গ্রামের বাড়ী জামতলী নারায়ণপুর, জামালপুর সদরে গেছে। তিনি যোগাযোগ করে জানতে পারেন, উক্ত ঠিকানায় চম্পা হিজড়া নামের একজনের বাড়ী আছে যার পূর্বের নাম নওশাদ। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, আনুমানিক ২০ বছর পূর্বে নওশাদের পিতা-মাতা মারা গেছেন এবং সে ঢাকায় বসবাস করে। মাঝে মধ্যে গ্রামে যান।
পিতা-মাতা না থাকা স্বত্ত্বেও লাশ পাওয়ার পরের দিন পিতার অসুস্থতার কথা বলে নওশাদ চম্পা হিজড়া বাসা ত্যাগ করে গ্রামে চলে যাওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। তাকে খোঁজাখুজির এক পর্যায়ে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে মোঃ রাকিব হাসান শাওন, পিতা-মোঃ শাহ আলম, সাং-ভাইজোড়া, থানা-বামনা, জেলা-বরগুনা এর নামে একটি ঠিকানা পাওয়া যায়। তদন্তকারী কর্মকর্তা মোঃ রাকিব হাসান শাওন এর স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করে তার পিতার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তার পিতার সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, তার ছেলে রাকিব ঢাকার আশুলিয়ায় এক হিজড়ার সাথে বসবাস করে। কিন্তু কোথায় থাকে সেই ঠিকানা তিনি বা পরিবারের কেউ জানেন না। রাকিব হাসান শাওনের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত একটি মোবাইল নম্বর এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান এই নম্বরটি তার ছেলে রাকিব হাসান ব্যবহার করে। কিন্তু লাশের ছবি দেখালেও তিনি তার ছেলের লাশ সনাক্ত করতে পারে নাই। পরবর্তীতে তদন্তকারী কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি ডিএনএ পরীক্ষা করান। ডিএনএ পরীক্ষার এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ঢাকার আশুলিয়ায় পাওয়া অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশই তার সন্তান মোঃ রাকিব হাসান শাওন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে পিবিআই ঢাকা জেলা তদন্ত টিম ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে নওশাদ চম্পা হিজড়াকে গ্রেফতারের লক্ষ্যে তার গ্রামের ঠিকানায় অভিযান পরিচালনা করেন। অব্যাহত তদন্তের অংশ হিসেবে পিবিআই ঢাকা জেলার তদন্ত টিম জামালপুর, শেরপুর বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর সহ গাইবান্ধা জেলার হিজড়া পল্লিতে অভিযান পরিচালনার করেন। এক পর্যায়ে, নওশাদ চম্পা হিজড়া তার নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলকার হিজড়া পল্লিতে আত্নগোপণ করে আছে মর্মে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে উক্ত হিজড়া পল্লিতে অভিযান পরিচালনা করে গত ১৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ রাত অনুমান ০৮.০০ টায় তাকে গ্রেফতার করে। ৭ দিনের পুলিশ রিমান্ডের আবেদন পূর্বক তাকে বিজ্ঞ আদালতে সোর্পদ করা হলে বিজ্ঞ আদালত ০৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে আসামী নওশাদ চম্পা স্বপ্না জনায়, সে জন্মগত ভাবে হিজড়া ছিল না। সে বিবাহিত পুরুষ এবং নাম ছিল নওশাদ। তার ১২ বছর বয়সী আকাশ নামের একজন পুত্র সন্তান আছে। প্রায় ১১ বছর আগে তার স্ত্রী মারা যায়। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সে কর্মবিমুখ হয়ে বেকার জীবন যাপন করতে থাকে এবং হতাশ হয়ে পড়ে। স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তার সাথে দেলু হিজড়ার পরিচয় হয়। দেলু হিজড়া নওশাদকে হিজড়া হওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং বলে হিজড়া হলে সে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারবে। দেলু হিজড়ার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নওশাদ হিজড়াদের দলে যোগ দেয়। এর দেড় বছর পর দেলু হিজড়ার কথামত খুলনার লোহাপাড়ায় একজন ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন করে মেয়ে হিজড়া হয়। সে ডাক্তার অনেক লোককে অপারেশন করে হিজড়া বানিয়েছে। হিজড়া হওয়ার পরে নওশাদ তার নাম পরিবর্তন করে চম্পা নাম ধারণ করে দেলু হিজড়ার অধীনে ৪/৫ বছর কাজ করে। পরবর্তীতে সে ঢাকার আশুলিয়ার এনায়েতপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করে। আশুলিয়ার এনায়েতপুরে বসাবাসকালে ভিকটিম রাকিব হাসান শাওন এর সাথে তার পরিচয় হয়। ভিকটিম রাকিব হাসান অবিবাহিত পুরুষ ছিল। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা একসাথে ভাড়া বাসায় বসবাস করতে শুরু করে। ভিকটিমের খরচ চম্পা বহন করতো। ২০২১ সালে ১লা জুন ভিকটিম রাকিব তার নিকট ১০০০/- টাকা চায়। টাকা না দেওয়ায় ভিকটিম রাকিব তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। ভিকটিম পুনরায় তার নিকট ২০ টাকা চায়। সে ভিকটিম রাকিবকে ২০ টাকা দিলে ঐ টাকা দিয়ে রাকিব ২টা মাইলাম ট্যাবলেট কিনে খায়। মাইলাম ট্যাবলেট কিনতে যাওয়ার সময় রাকিব তার মোবাইল ফোনটি বাসায় রেখে যায়। ঐ সময় ভিকটিমের মোবাইলে রিপা নামের একজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ফোন করে। নওশাদ চম্পা স্বপ্না ফোনটি রিসিভ করে জানতে পারে, রিপার সাথেও ভিকটিম রাকিবের প্রেমের সম্পর্ক সহ শারিরীক সম্পর্ক রয়েছে। মাইলাম ট্যাবলেট কিনে রাকিব বাসায় ফিসে আসলে নওশাদ চম্পা ভিকটিম রাকিবের নিকট রিপার বিষয়ে জানতে চায়। এই নিয়ে তাদের মধ্যে বাতবিতন্ডা হলে নওশাদ চম্পা স্বপ্না ভিকটিম রাকিবের গলায় গামছা পেচিঁয়ে তাকে হত্যা করে। হত্যার পর আসামী নওশাদ তার গুরুমা রুমি হিজড়ার বাসা থেকে চটের বস্তা নিয়ে এসে উক্ত বস্তায় ভিকটিম রাকিবের লাশটি ভরে পাশের রুমে রেখে গুম করার সুযোগ খুঁজতে থাকে। কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে তার জন্য সে দিনের বেলা তার কাজকর্ম শেষ করে বাসায় ফিরে এসে রাত্রী যাপন করতো। ৫ দিন পর ৬ষ্ঠ দিনের মাথায় গত ৭ জুন ২০২১ তারিখ প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে সন্ধার পরে এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় সে বস্তায় ভরে রাখা ভিকটিমের লাশটি নিয়ে এসে রাতের অন্ধকারে বাসার পাশে ঝোপের মধ্যে (ঘটনাস্থলে) ফেলে রেখে সে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকে। পরের দিন অর্থাৎ ৮ জুন ২০২১ তারিখ সকালে স্থানীয় লোকজন বস্তাবন্দি লাশ দেখতে পেয়ে থানা পুলিশকে খবর দিলে নওশাদ চম্পা স্বপ্না পালিয়ে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানা এলকার হিজড়া পল্লিতে গিয়ে তার নওশাদ চম্পা নাম পরিবর্তন করে স্বপ্না হিজড়া নামে আত্নগোপণ করে।
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসামী নওশাদ চম্পা স্বপ্না হিজড়াকে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে সে ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে বিজ্ঞ আদালতে ফৌঃ কাঃ বিঃ এর ১৬৪ ধারায় অপরাধ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
Leave a Reply