অনলাইন ডেস্ক ;
ফ্যাসিবাদ পতনের এক বছর পর গত ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। এবার স্বাভাবিক কারণেই রাষ্ট্রীয় ভাবে কোন শহীদ দিবস পালিত হয়নি। সরকারের জুলাই বিপ্লবের অন্যতম চেতনা ছিলো ফ্যাসিবাদের শেকড় উপড়ে ফেলা। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের আদর্শিক নেতা।
তার হাত দিয়েই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী দর্শনের সূচনা হয়েছিল। এই কারণেই ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার মুখে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন পালিত হয়নি। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এবারের ১৫ আগস্টে শোক দিবসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে শোবিজের তারকারা শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর দিনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন রকম পোস্ট দিয়েছিলেন। আর এই সমস্ত পোস্ট গুলো সারা দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে শোক জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন জয়া আহসান, শাকিব খান, কোনাল, ইরফান সাজ্জাদ, খায়রুল বাশারের মতো বড় বড় জনপ্রিয় তারকারা। এই তারকারা কেন হঠাৎ এ ধরনের পোস্ট দিলেন এবং তারা এখান থেকে কি অর্জন করতে চাইলেন? যেখানে বাংলাদেশের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক হিসেবে মনে করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। জুলাই বিপ্লবের মূল আকাঙ্খা যেখানে ছিলো একটি বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, সেখানে এই ধরনের পোস্ট দেয়ার উদ্দেশ্য কি সেটি নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা রকমের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এটা কি নিছক আবেগ নাকি এর পিছনে লুকিয়ে আছে ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের গভীর ষড়যন্ত্র?
১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের একাধিক তারকা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ‘শ্রদ্ধা’ জানিয়ে যেসব পোস্ট করেছেন, তা নিছক আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত প্রচারণার অংশ ছিলো বলে অনেকে মনে করেন।
এটা ছিলো একটি পরিকল্পিত মনস্তাত্বিক প্রচারণা। আর এই প্রচারণা হয়েছে প্রথম আলোর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলমান জনঅসন্তোষ ও বিশেষ করে জুলাইয়ের আন্দোলন ও গণহত্যার ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে সাধারণ মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ১৫ আগস্ট সামাজিক মাধ্যমে শোকপ্রকাশের নামে শেখ মুজিবকে একমাত্রায় গৌরবান্বিত করার চেষ্টা চালানো হয়। যেখানে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের শাসনামলে ঘটে যাওয়া রক্ষীবাহিনীর দমন-পীড়ন, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, এবং একদলীয় শাসনের বাস্তবতা পুরোপুরি উপেক্ষিত ছিলো।
এই শোক জানানোর পাশাপাশি বলা হয়নি, আমরা মুজিবকে সম্মান করি, কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বৈরাচার বা গণহত্যাকে সমর্থন করি না। বরং এই পোস্টগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ‘শুদ্ধ’ ভাবমূর্তি তৈরির জন্য ব্যবহার করা একটি প্রোপাগান্ডার অংশ।
প্রচারণার শুরু হয় ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে যেখানে শোবিজ অঙ্গনের পরিচিত মুখ তারিন, তমালিকা কর্মকার, সাজু খাদেম, অরুণা বিশ্বাস এবং শামীমা তুষ্টি প্রাথমিকভাবে পোস্ট দেন। এরপর বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেগাস্টার শাকিব খান।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই পুরো প্রচারণার নেপথ্যে কাজ করেছেন একজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আওয়ামী ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক, যিনি বিনোদন জগতেও বিশেষ প্রভাবশালী। তার তত্ত্বাবধানেই ‘অরাজনৈতিক’ ভাবমূর্তির কিছু সেলিব্রেটিদের দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ আগস্টকে পুঁজি করে সহানুভূতি তৈরির প্রয়াস চালানো হয়। এই সাংবাদিক প্রথম আলোতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের আয়োজক হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তার স্ত্রী একজন গায়িকা। এই পুরস্কার প্রচারণার আরেকজন উদ্যোক্তা ছিলেন জাহের আলভী। সম্প্রতি প্রথম আলো তার উপর বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখেছে যে সমস্ত তারকা শিল্পীরা এই ধরনের পোস্ট গুলো দিয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই একটি বিশেষ ঘরানার লোক। আমরা সকলেই জানি যে, প্রথম আলো নিয়ন্ত্রিত এবং গৃহপালিত কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী রয়েছে। বিশেষ করে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের নামে তারা শিল্পী জগতে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। যে সিন্ডিকেটের কাজ হলো প্রথম প্রথম আলোর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করা। প্রথম আলো যেভাবে নির্দেশ দেবে, সেভাবে কাজ করা এবং প্রথম আলোর স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এর মাধ্যমে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গোষ্ঠী একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তৈরি করেছে মিডিয়া জগতে। তারাই মেরিল-প্রথম আলো তারকা পুরস্কার পায় যারা প্রথম আলোর একান্ত অনুগত, গৃহপালিত। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদেরকে হাজির করায় এবং এভাবে সাংস্কৃতিক জগতে একটি প্রভাব তৈরি করেছে প্রথম আলো। যে সংস্কৃতি বলয়ের প্রধান উদ্দেশ্যেই হলো বাংলাদেশী সংস্কৃতি বিরোধী অবস্থান এবং আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখা। ভারতীয় সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান। যখন ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের পতন হয়। তখন এবারের পতনে শুধু আওয়ামী লীগের পতন হয়নি, আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি অঙ্গনেও একটি বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসছে। কারণ চব্বিশে গণ-অভ্যুত্থানে সাংস্কৃতিক কর্মীরাও রাজপথে নেমেছিলেন। তারা স্লোগান দিয়েছেন, তারা তাদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সেই সময় প্রথম আলো ঘরানার শিল্পীরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাদের এই আওয়ামী, ভারত বিরোধী এবং ফ্যাসিবাদী বিরোধী অবস্থান প্রথম আলো মেনে নিতে পারেনি। একারণেই প্রথম আলো এক বছরের মধ্যে তাদেরকে পুনঃসংগঠিত করেছে। সেক্যুলার সংস্কৃতি নামে আওয়ামী পুনর্বাসনের মিশনে ১৫ আগস্টকে তারা বেছে নেয়। যার কারণে এবারের ১৫ আগস্টে দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রথম আলো নিয়ন্ত্রিত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সংস্কৃতিকরা প্রায় একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করে বিভিন্ন পোস্ট দিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর দিনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে।
আমরা দেখেছি যে তারকাদের মধ্যে শাকিব খান, জয়া আহসান, নাজিফা তুষি, আরশ খান, ইরফান সাজ্জাদ, জাহের আলভী, নির্মাতা ও অভিনেতা শরাফ আহমেদ, মডেল পিয়া জান্নাতুল, সংগীতশিল্পী কোনাল, ব্যান্ড আর্টসেলের লিড ভোকালিস্ট লিংকন ডি কস্তা, খায়রুল বাসারসহ তারকারা পোস্ট দিয়েছেন। যাদের প্রত্যেকেই প্রথম আলোর নিয়ন্ত্রণে।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল আওয়ামী সংস্কৃতি এবং আওয়ামী রাজনীতিকে সমর্থন করার জন্য। প্রথম আলো তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা রকম ছলাকলা কৌশলে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদকে লালন করেছে, ফ্যাসিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে। ফ্যাসিবাদের বিস্তারের জন্য যে দার্শনিক ভিত্তি দরকার, সেই দার্শনিক ভিত্তি সব সময় প্রথম আলো দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, শিল্প, সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রথম আলো তার একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। যে নেটওয়ার্ক আসলে ফ্যাসিবাদকে লালন করে এবং ফ্যাসিবাদের তোষণ করে।
আমরা যদি দেখি যে, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার যারা পায় এবং প্রথম আলোর ঘরানায় যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করে, তারা প্রত্যেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক, উচ্ছিষ্টভোগী অথবা আওয়ামী লীগের চিন্তাচেতনাকে ধারণ করে। একইভাবে প্রথম আলো নিয়ন্ত্রিত যেসব সুশীল বুদ্ধিজীবী আছেন, তারা আওয়ামী লীগের কিছু কিছু বিষয়ে সমালোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদকে লালন করেন। ৫ আগস্টের পর থেকে তারা বর্তমান সরকার, বিএনপি এবং অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমালোচনায় বিদ্ধ করছে। অথচ গত ১৬ বছর আওয়ামী শাসনামলে তারা এসব নিয়ে কোনো কথাই বলেননি।
এখান থেকে বোঝা যায় যে, আওয়ামী লীগের পতনের এক বছর পর প্রথম আলো তার নেটওয়ার্ককে সক্রিয় করেছে। তারা আওয়ামী পুনর্বাসনের একটি মিশনে নেমেছে। সেই মিশনের কারণেই তারা কথায় কথায় বিএনপির বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ উত্থাপন করছে। জামাতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ছোট ছোট ভুলগুলো ফলাও করে প্রকাশ করছে এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আওয়ামী লীগ তোষণ এবং আওয়ামী বন্দনা নতুন করে শুরু করেছে।
এর একটি চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটলো গত ১৫ আগস্ট। যেখানে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রায় সকল শিল্পী বিবৃতি দিয়েছে। প্রথম আলোর লেখক প্রায় সকল বুদ্ধিজীবী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক জানিয়েছে। তাহলে কি প্রথম আলো ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের জন্য আবার নতুন করে তারা মাঠে নামলো? ১৫ আগস্টের পর এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে।
Leave a Reply