আমিনুল ইসলাম::টেকনাফ
সৌন্দর্য তার পরতে পরতে। যতদূর যায় দু’চোখ, তাতে লেগে থাকে সবুজ পাহাড়, কোলজোড়া শুভ্র মেঘ, বালুকারাশি, সবুজ ঝাউবন, ফেনিল প্রমত্তা জলরাশি।
বিকেলটা সুন্দর আরও!গোধূলিরাগে রাঙা বধূর মতো। সন্ধ্যা পেরুলে মিটিমিটি তারায় সলিল গর্জনে নাচে ঊর্বশী।
বলছি কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরের নীল জলরাশির সবুজকন্যা দেশের সর্বদক্ষিণের জনপদ টেকনাফের কথা। সাগর-পাহাড়ের অপূর্ব মিতালি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, নানা ধর্মের-বর্ণের মানুষের অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থান, পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের সমাহার সহ প্রকৃতির ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য, স্বাস্থ্যকর স্থান এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে টেকনাফ অনন্য। মেরিন ড্রাইভ ধরে ভ্রমণ যেন হার মানিয়ে দেয় যেকোন ভিডিও গেইমস’কেও। কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগর ও পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে দীর্ঘ ৮০ কিলোমিটার এ সড়কটি। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের পাশ দিয়ে তৈরি বিশ্বের দীর্ঘতম এ মেরিন ড্রাইভ সড়কটি।
পাশাপাশি টেকনাফ নামটি বর্তমানে বিভিন্নভাবে সমগ্র দেশে আলোচিত ও সমালোচিত একটি নাম। ইয়াবার স্বর্গ রাজ্য হিসেবে এটি পুরো দেশে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকান্ড নিয়ে টেকনাফ নামটি “টক অব দ্য কান্ট্রি” তে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পের অংশ হিসেবেও জড়িয়ে আছে এ টেকনাফের নাম। এই রোহিংগা সংকটকে বলা হচ্ছে এই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট। এরকম নানা কারণে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নিবন্ধ হয়েছে টেকনাফের প্রতি। এতকিছুর ভীড়েও টেকনাফ প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় ভরপুর হওয়াতে ভ্রমণ পিপাসু ও সৌখিনপ্রিয় মানুষদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমির নাম।সীমান্ত নগরী এই উপজেলাটির রূপ-গুণ-বৈচিত্র্যের অন্ত নেই। কোলজুড়ে বর্ষার যৌবনবতী নাফ, ওপারে মায়ানমারের পাহাড়, এপারের তীরজুড়ে ছোট ম্যানগ্রোভ বন, আরেকপাশে তারুণ্যদীপ্ত সবুজ পাহাড়, শেষ মাথায় টেকনাফ সমুদ্র সৈকত। তাই তো মনভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে চাইলে টেকনাফের প্রাকৃতিক শোভায় ঘেরা বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান ঘুরে আসার বিকল্প নেই। এখানে রয়েছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, ছেঁড়া দ্বীপ, নোয়াখালি পাড়ার ঝর্ণা সমূহ, মাথিনের কূপ, টেকনাফ গেম রিজার্ভ বন, গর্জন বাগান, জালিয়ার দ্বীপ, টেকনাফ সমুদ্র সৈকতসহ রয়েছে আরো অনেক অপূর্ব সব স্থান। এ সকল স্থানের মধ্যে বর্তমানে ভ্রমণ পিপাসুদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী পাড়ার ঝর্ণা সমূহ। প্রাকৃতিক এই ঝর্ণা সমূহ এডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য দারুণ একটি ভ্রমণ স্থান। যারা টেকনাফ ভ্রমণে রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে চান তাদের জন্যে এই ঝর্ণা সমূহ হতে পারে সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গা।
কক্সবাজার শহর থেকে ৬৫-৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালী পাড়াস্থ বাঘঘোনা বাজার এবং ইলিয়াছ কোবরা বাজার সংলগ্নে এইসব ঝর্ণার অবস্থান। মনোরম পাহাড়ঘেরা পরিবেশ ,পাখির ডাক আর বন্যপ্রাণীর আনাগোনাময় এই সব ঝর্ণা গুলো দারুণ একটি আকর্ষণীয় স্থান। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ফুট উপরে অবস্থান।
মূলত নোয়াখালি পাড়ায় বড় আকারের মোট চারটি ঝর্ণা রয়েছে। ঝর্ণায় যাওয়ার রাস্তার পাশে রয়েছে দু’টি বাজার। একটি বাঘঘোনা বাজার, অন্যটি বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনয় শিল্পী ইলিয়াস কোবরার নামে গড়ে ওঠা ইলিয়াস কোবরা বাজার। ঝর্ণায় যাওয়ার পথ পাথর বিছানো। বর্ষা মৌসুমে এ পথ যথেষ্ট পিচ্ছিল হয়ে যায়। হাঁটার সময় এই পথ আপনাকে শিহরিত করবে।দু’পাশে পাহাড়ে ঘেরা পথ ধরে যতই সম্মুখে অগ্রসর হবেন আপনার মনে হবে হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর পথ ধরে এগিয়ে চলছেন। পাখির ডাক, মনোরম পাহাড় ঘেরা গাছপালা ও মাঝেমধ্যে বাঁদুরের হাঁক ডাক আর উড়া উড়িতে দারুণ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাবেন। ঝর্ণার বেয়ে আসা জল চলার পথটাকে আরও উপভোগ্য করে তুলবে। হিম শীতল জল কোথাও হাঁটু পরিমাণ, কোথাও কোমর আবার কোথাও বুক সমান।পাহাড়কে আলিঙ্গন করা পাথরের দেয়ালের গা বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে অনবরত পানি ঝরে। এর যত ভিতর প্রবেশ করবেন পানির গভীরতা তত বাড়তে থাকবে। শুকনো মৌসুমে চলার পথ প্রায় জলশূন্য থাকে। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে অতি বৃষ্টিতে অনেক সময় গলা পরিমাণ পানি হয়।এখানকার পানি বেশ ঠাণ্ডা আর স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ মিষ্টি পানিতে অনেক সময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছেরও দেখা মেলে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফ যাওয়া যায় সড়কপথে। এ পথে চলাচলকারী এসি বাস হল সেন্টমার্টিন সার্ভিস। এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস, হানিফ এন্টারপ্রাইজের নন-এসি বাস চলে এই পথে।
সবচেয়ে আরামদায়ক কক্সবাজারের কলাতলী মোড় থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে সিএনজি, মিনি-কার এবং নীল দরিয়া বাস সার্ভিস দিয়ে যাতায়াত। জনপ্রতি ভাড়া ১৭০-২৫০ টাকা। টেকনাফ স্টেশন থেকে জনপ্রতি ভাড়া ৩০-৪০ টাকা।
ঝর্ণায় গোসলের ক্ষেত্রে সতর্কতাঃ
১)মুষলধারে বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলের সাথে ছোট ছোট পাথরকণা থাকে। ঝর্ণার পানি বেশি হলে পাথরকণা গুলো অনেক উঁচু থেকে ঝর্ণার পানির সাথে মাথায় পড়ে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
২) রাস্তা স্লিপারি। (বিরবিজ্জা) নিচে শক্ত পাথর বিছানো। অসাবধানতা বশত: পড়ে গিয়ে দাঁত/হাত/পা ভেঙ্গে যেতে পারে!
মোদ্দাকথা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম নিদর্শন ঝর্ণা বা জলপ্রপাত। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা ফেলে ঝর্ণা জলে ভিজতে কার না ভালো লাগে। রূপ লাবণ্যের বাংলাদেশে পাহাড়-নদী সবুজে শ্যামলে সৌন্দর্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে ভ্রমণ পিপাসুদের। দরকার শুধু একটু সময়ের। মনকে দু’দণ্ড শান্তি দিতে ঘুরে আসতে পারেন অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ নোয়াখালী পাড়ার ঝর্ণায়।যেটি নিরাপত্তার বিচারে সম্পূর্ণ নিরা নিরাপত্তা’।
Leave a Reply