সাঈদুর রহমান রিমন, ঢাকা থেকে….
কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাস বরখাস্ত হওয়ার পর মেজর সিনহা হত্যা মামলায় হাজতবাস করলেও তার বখড়াবাজি চলছেই। তার ঘনিষ্ঠ সহচর পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো সেসব বখড়ার টাকা সংগ্রহ করে তা জমা রাখেন স্থানীয় এক মাদ্রাসা প্রিন্সিপ্যালের কাছে। পরবর্তীতে ফয়সাল-সোহেল ও রফিক-হাসান সিন্ডিকেটের হাত ঘুরে সেসব টাকা দুবাইতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মেজর হত্যাকান্ডের পর পরই রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিম বাহিনীর মাধ্যমে সংগৃহিত প্রায় তিন কোটি টাকা ‘ফয়সাল-সোহেল সহোদর সিন্ডিকেটের’ মাধ্যমে পাচার হয়। এবার পাচার করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। যে কোনো মুহূর্তে রফিক-হাসান সিন্ডিকেটের অন্যতম হাসান বিপুল পরিমাণের এ টাকা নিয়ে দুবাইয়ের পথে রওনা দিবেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। দুবাইতে অবস্থানকারী সোহেলের তত্বাবধানে ওসি প্রদীপের অত্যাধুনিক শপিংমল চালু হয়েছে, এখন এর আশেপাশেই নির্মিত হচ্ছে দুটি ফ্ল্যাট।
টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার মরিচ্যাঘোনা এলাকার দুই সহোদর ফায়সাল-সোহেল এবং রফিক-হাসান গোটা এলাকায় সমধিক পরিচিত। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা শত শত কোটি টাকা দুবাইতে পাচার করেন, এই পাচার করা টাকা বরাবরই রিসিভ করেন ফয়সালের ভাই মোঃ সোহেল। হুন্ডি বাণিজ্য সচল রাখাসহ নানাবিধ তৎপরতা চালানোর সুবিধার্থে সোহেল বেশ কিছুদিন যাবত স্বপরিবারেই দুবাই থাকছেন বলেও জানা গেছে। সোহেল বিদেশে বিলাসবহুল গাড়ী, বাড়ি, মার্কেটসহ বহুতল ভবন নির্মাণ, ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করছেন। একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পদমর্যদার নেতা কর্মীদের দুবাইতে প্রটোকলের আয়োজন করেন বলে জানা যায়। বিকাশ নামধারী হুন্ডি ব্যবসায়ী রফিকের মাধ্যমে দুবাইতে কোটি কোটি টাকা পাচার ছাড়া সরাসরি ইয়াবার চালান দুবাই নিয়ে বেশ কয়েকবার খালাস করার খবর চাউর হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা দুর্ধর্ষ ডাকাত হাকিম বাহিনী আরো কয়েক বছর আগেই টেকনাফের পাহাড়ি জঙ্গলে আস্তানা বানিয়ে খুন খারাবি ডাকাতি রাহাজানি চালাতে থাকে। তারা বাংলাদেশে এবং সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে ঢুকেও অবলীলায় বেশুমার ডাকাতি ও লুটপাট চালায়। ওসি প্রদীপ টেকনাফ মডেল থানায় যোগদান করেই রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিম ও তার বাহিনীকে আটক করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু একপর্যায়ে হ্নীলার ফয়সালের মাধ্যমে হাকিম ডাকাত ও ওসি প্রদীপের সমঝোতা হয়। প্রতিমাসে কোটি টাকা বখড়া দেয়ার চুক্তিতে হাকিম ডাকাতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠে ওসি প্রদীপ নিজেই। জনশ্রুতি আছে- ফয়সালের বাড়ীর তলদেশে একটি বিশাল সুরঙ্গ রয়েছে। এই সুরঙ্গটি তৈরী করেছে রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম। পাহাড়ে অভিযান চলাকালে হাকিম ডাকাত তার সুরঙ্গ বাড়িতে অবস্থান করে থাকে। এই হাকিম ডাকাতের জন্য পাহাড়ে খাদ্য সামগ্রী, অন্য ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত সিম ফয়সাল কর্তৃক সরবরাহ করার কথাও প্রচলিত আছে।
টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ধরপাকড় শুরু হলে ফয়সাল নিজের নাম পরিবর্তন করে ফরিদুল আলম পিতা ফজলুল আলম নামে পাসপোর্ট করে দুবাই পালিয়ে যায়। সেখানে অবস্থানকালে মানবপাচারের সাথে জড়িয়ে পড়ে। পরে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ হয়। সেই সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে মানবপাচার ও হুন্ডির ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে অন্য আরেকটি পাসপোর্টে তিনি বাংলাদেশ চলে আসেন। তার ভাই মোহাম্মদ সোহেল পিতা হাজী ফজলু নামে পিতার নাম পরিবর্তন করে অপর একটি পাসপোর্ট করে ছদ্ম নাম শুধু সোহেল দিয়ে দুবাইতে পাড়ি জমায়। সেখানে “আল-সোহেল টেকনিক্যাল সার্ভিস” নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানও খুলে বসেন তিনি।
পরবর্তীতে দুবাইতে থাকা সহোদর ফয়সালকে টেকনাফের ইয়াবার রমরমা ব্যবসার স্বার্থে দেশে ফেরত পাঠায়। তিনি যুক্ত হন বার্মাইয়া শীর্ষ ডাকাত আব্দুল হাকিমের সাথে। মিয়ানমার থেকে বস্তা বস্তা ইয়াবা এনে তাদের ঘরের সুরঙ্গতে স্তুপ করে। পরে তাদের নিজস্ব লোক দিয়ে ইয়াবাগুলো সারাদেশে সরবরাহ করে বিশাল নের্টওয়াক গড়ে তুলেন। এ ব্যাপারে ফয়সালের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়। মরিচ্যা ঘোনার সুরঙ্গ ভবনের ডন ফয়সালের স্ত্রী পারভিন আক্তারের বোন জেসমিন আক্তার ইয়াবা নিয়ে এখনো শ্রীঘরে রয়েছে। তার স্বামী মুফিদ আলমও মাস কয়েক আগে মেরিন ড্রাইভে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
অপর সিন্ডিকেটের মূল হোতা রফিক অল্প কিছু দিনের মধ্যেই স্থাবর অস্থাবর অঢেল সহায় সম্পত্তি জমি, জমা দালান-কোঠা উচু বাউন্ডারীর বিলাসবহুল বাড়ীর মালিক সেজে বসেছেন। সম্প্রতি রফিক স্বস্ত্রীক সিন্ডিকেটের ইয়াবার চালান নিয়ে চট্টগ্রামস্থ রেলওয়ে পুলিশের নিকট ধরা পড়ে। মোটা অংকের বিনিময়ে স্ত্রী ছাড়া পেতে সক্ষম হয়। রফিক দীর্ঘদিন কারাবরণ করে জামিনে মুক্তি লাভ করেই ফের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। তার পূর্ব পুরুষ মিয়ানমারের নাগরিক, এই সুবাদে ইয়াবা আনার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও পায় তারা।
অন্যদিকে দুবাই অবস্থানকারী ফরিদুল আলম সোহেল জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে, স্থানীয় সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি ও আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের বিরুদ্ধে তাদের ভেরিফাইড ফেইসবুক থেকে কত স্ট্যাটাসে সরকার বিরোধী অপপ্রচার, অশ্লীল ভাষায় কটাক্ষ করে মিথ্যা কল্প কাহিনী সাজিয়ে ছড়াচ্ছে তাও কি চোখে পড়ছেনা আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের! সোহেলের হাত ধরেই ওসি প্রদীপ অষ্ট্রেলিয়ায় বাড়ি ক্রয় করে বলে গুঞ্জন আছে।
ইতিপূর্বে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সুরঙ্গ বাড়ির সংবাদ প্রকাশিত হলে সাবেক ওসি প্রদীপ নিজেই ধামাচাপা দেয় এবং তার বাড়িতে গিয়ে সুরঙ্গের মুখটি লোক দেখানো বন্ধ করে। চলতি বছরের ২৭ মে কক্সবাজার র্যাবের হাতে জানারঘোনা এলাকা ফয়সাল সিন্ডিকেটের দুই সদস্যকে ১৯ হাজার ইয়াবাসহ আটক করে। এরা হলেন আলী আকবরপাড়ার মনির আহমদের ছেলে হেলাল উদ্দিন ও আবদুল মাবুদের ছেলে ইউনুছ (২৮)। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন।
Leave a Reply