মোঃ আরাফাত সানি, টেকনাফ।
ন্যায় উন্নয়নশীল দেশসমূহে দারিদ্র্য একটি দুষ্টচক্র হিসেবে কাজ করে। শুধুমাত্র নিজস্ব প্রচেষ্টায় জনগনের পক্ষে দারিদ্র্যর কষাঘাত থেকে মুক্ত হওয়া খুবই কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। টেকনাফে দারিদ্র্যর দুষ্টচক্র ভেঙ্গে এর কবল থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে প্রয়োজন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। দারিদ্র্য বিমোচনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম পদক্ষেপ হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী কেননা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী দারিদ্র্য বিমোচনে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। যার ফলে উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্য দূর করার বড় হাতিয়ার হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী যা দরিদ্র, অসহায় ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেবার বিশেষ ট্যুল হিসেবে কাজ করছে।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখছে, এতে কোনো সংশয় নেই, বর্তমান টেকনাফে নানা ধরনের অনিয়ম-অস্বচ্ছতার বিরূপ প্রভাব পড়েছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে। গেল অর্থবছরে এ ধরনের কর্মসূচির লাখ-লাখ টাকা বিতরণ সম্ভব হয়নি। এতে দুস্থদের চলমান প্রশিক্ষণ, জীবন মানোন্নয়ন ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। বস্তুত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দুস্থ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাতা বিতরণের স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক আগে থেকেই অভিযোগ ছিল। কাজেই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কতটা কঠোর ছিল এটা এক প্রশ্ন। ইতোমধ্যে ভুয়া ও নিরুদ্দেশ ভাতাভোগী চিহ্নিত হওয়ার তথ্য থেকেই স্পষ্ট, এ প্রকল্পে অনিয়ম কতটা বিস্তার লাভ করেছিল। কথা হলো, অনিয়ম চিহ্নিত করাই কি যথেষ্ট? এই দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে অন্যান্য প্রকল্পেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অনিয়মের বিষয়টি টেকনাফে বহুল আলোচিত। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএসএস) মধ্যবর্তী উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, যোগ্য না হয়েও ভাতা নিচ্ছেন ৪৬ শতাংশ। আর বয়স্ক ভাতায় শর্ত পূরণ করেননি ৫৯ শতাংশ। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতায় অনিয়ম ধরা পড়েছে ২৩ শতাংশ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় বলা হয়, সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্যভাণ্ডারে নাম অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা ঘুস দিতে হয় উপকারভোগীদের।
এমনকি অতিদরিদ্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছ থেকেও ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ঘুস নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে সুবর্ণ কার্ডের জন্য এক থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যস্থা নেওয়া জরুরি।
এক সমীক্ষায় বলা হয়, টেকনাফ থেকে সারাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে দরিদ্রতার হার কমবে ১২ শতাংশ। বস্তুত, এ কর্মসূচির অর্থ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বহু মানুষ দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বেশি সক্ষমতা নিয়ে উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারবে, যা দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করবে। মহামারির কারণে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষ কতটা ক্ষতির শিকার তা বহুল আলোচিত। এ প্রেক্ষাপটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি আরও বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে ত্রুটি-বিচ্যুতি দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব। কাজেই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে এ প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মসূচির উপকারভোগীদের প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ বাড়ানো দরকার।
সার্বিক আলোচনায় প্রতীয়মান যে, টেকনাফে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভিত্তিক পুরাতন পদ্ধতির কর্মসূচিসমূহ দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখলেও সার্বিকভাবে মানুষের জীবনমান উন্নত করে টেকসই উন্নয়নে শতভাগ সহায়ক নয়। তাই প্রয়োজন জীবনচক্রমূখী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দ্রুত এবং কার্যকর বাস্তবায়ন। আমরা বিশ্বাস করি জীবন চক্রমূখী সমন্বিত টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট -২০৩০ ও রূপকল্প- ২০৪১ বাস্তবায়ন সম্ভবপর হবে। আমরা আশাবাদী, টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বর্তমান সরকারের গৃহীত উদ্ভাবনীমূলক পদক্ষেপের কারনে বাংলাদেশ মহামারী করোনার ক্ষতিসহ সাম্প্রতিক সময়ের সমস্যা পুষিয়ে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ ও ভিশন-২০৪১ সফল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে।
এ বিষয়ে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তার সাথে নিকট যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয় গুলো খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান।
টেকনাফ উপজেলার নবাগত নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান জানান, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হবে।
Leave a Reply