
টেকনাফ ৭১ ডেস্ক
টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশকে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত বলেছেন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রদীপ কুমার দাশ জুতা পরা পা দিয়ে সিনহার বুকের বাম পাঁজরে জোরে আঘাত করে দুটি হাড় ভেঙে দেন এবং গলার বাম পাশে পা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। বিষয়টি প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
সম্প্রতি আলোচিত এই হত্যা মামলার ৩৭৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং এতে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. সগীর হোসেন। এর আগে গত ২ জুন হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড এবং ৬ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করেছিলেন।
মৃত্যু নিশ্চিত করেন প্রদীপ, গুলি করেন লিয়াকত পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট উল্লেখ করেছেন, ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রদীপ কুমার দাশ আলোচ্য হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ও পরিকল্পনাকারী। তিনি ঘটনার সময় উপস্থিত থেকে ভিকটিমের বুকের হাড় ভাঙাসহ গলা চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন।’
অন্যদিকে পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ভূমিকা প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, ‘প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষী, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যালোচনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, লিয়াকত আলী পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিরস্ত্র ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সরকারি পিস্তল দিয়ে শরীরের ওপরের অংশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরপর চারটি গুলি করেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই গুলির আঘাতেই ভিকটিমের মৃত্যু হয়েছে।’
আদালত আরও বলেন, যেহেতু প্রদীপ কুমার দাশ মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন এবং লিয়াকত আলী গুলি চালিয়েছেন, তাই বিচারিক আদালত সঠিকভাবে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন।
মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন– বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন– বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মা এবং পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের বিষয়ে উচ্চ আদালত বলেন, তাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে ষড়যন্ত্র, সহায়তা ও সাধারণ অভিপ্রায়ের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিচারিক আদালত অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তাদের যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন, তা সঠিক ও যুক্তিযুক্ত। তাই তর্কিত রায়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো অবকাশ নেই।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় করা মামলার বিচার শেষে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত দুজনকে মৃত্যুদণ্ড, ছয়জনকে যাবজ্জীবন ও সাতজনকে খালাস দেন।
পরবর্তীতে নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয় এবং দণ্ডিত আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করেন। শুনানি শেষে গত ২ জুন হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। এখন এই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর আসামিপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করবে, যার মাধ্যমে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে।
Leave a Reply